ব্যস্ততার মাঝেও নিজেকে খুশি রাখার উপায়
এই দুনিয়ায় কেউ এমন নেই যে খুশি থাকতে চায় না। সবাই চায়!!! কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি সহ নানান জটিলত্য মানুষ যেনো অনেক সময় হাসতেই ভুলে যায় ।
আমাদের জগৎ সংসারে বহু ধরনের মানুষ আছে, যারা কিসের পেছনে দৌড়াচ্ছে, কেনো দৌড়াচ্ছে নিজেরাই জানে না। এত প্রতিযোগিতার এই জীবনে কারোরই এতটুকু সময় নেই নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করার যে
আমি কী চাই?
আমি কি সুখী?
আমি কি এটাই চেয়েছি জীবনের কাছে?
মানুষ ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে। কার কত ব্যাংক ব্যালেন্স আছে, কে কত দামের গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়, কার ছেলেমেয়ে কোন স্কুলে পড়ে, কার রেজাল্ট কত ভালো, কেন সে অন্যের মতো হতে পারছে না, এই সেই আরও কত কী!
মানুষ সুখের সন্ধানে তাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলো নিজের করে পেতে চায়। সারাদিন ছুটতে থাকে সেগুলো পাওয়ার জন্য। কিন্তু দিন শেষে তারা তাদের অন্তরে গ্লানি, শূন্যতা আর হতাশার মুখোমুখি হয়। কারন তারা খুশি আর সুখ পাওয়ার জন্য অবিরাম ভুল জায়গায় সন্ধান করে চলে।
অনেক সময় আমরা ক্ষণস্থায়ী সুখের জন্য অনেক ধরনের দুর্বল জিনিস আঁকড়ে ধরি। কিন্তু পরে দেখা যায় সেই খুশিও বেশিদিন থাকে না। তাহলে কোন সে জিনিস যা আমাদের সর্বদা খুশি অনুভব করাতে সাহায্য করতে পারে ? একজন ব্যক্তির মন যতটা প্রফুল্ল থাকবে সেই ব্যক্তি ততটা খুশি থাকবে। নিম্নের উপায়গুলো কাজে লাগানোর মাধ্যমে আমরা আমাদের মনকে প্রফুল্ল রাখতে পারি :-
১. অবসর পেলেই ঘুমিয়ে নেয়া
ঘুম মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মানুষ ভালো থাকতে পারে না। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মানুষ মানসিক চাপ, হীনমন্যতা, শারীরিক অসুস্থতায়ও ভোগে। টানা কাজের ফলে একঘেয়েমি চলে আসে যা আমাদের মন এবং শরীরে ক্লান্তি নিয়ে আসে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম এবং বিশ্রাম শরীরকে সতেজ রাখতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে উঠার একটি নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করা যায়। কেননা নিয়মিত সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানো মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
২. হালকা ব্যায়াম করা
কাজ করতে করতে ৫ মিনিটের বিরতি নিয়ে অল্প কিছু ব্যায়াম বা যোগ ব্যায়াম করে নিলে শরীরটাও যেমন একটু ভালো লাগে, মনটাও ভালো লাগে। ব্যায়াম মানসিক চাপ তৈরিকারী হরমোনের নিঃসরণ কমায়। সুখি হরমোন হিসেবে পরিচিত এনডোরফিনের মাত্রা বাড়ায়। তাই যত ব্যস্তই থাকুন না কেন একটু সময় বের করে ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন। যদি জিমে গিয়ে ব্যায়াম করার সময় না হয় তবে অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন। সেটিও চাপ কমাতে কাজে দেবে।
৩. পছন্দের কাজগুলা করা
একেকজন মানুষের পছন্দ একেক রকমের হয়। ব্যস্ততার সময় পছন্দের কাজগুলো করতে বলা হয় কারণ এতে মন ভালো হয়ে যায়। অন্য কোন কাজ করার ফুরসত না মিললেও নিজ পছন্দের কোন একটা কাজ করলেই মন অনেকটা ভালো হয়ে যায়। ব্যস্ততার মধ্যে মন ভালো রাখার জন্য নিজের ভালোলাগার কাজের কোন বিকল্প নেই।
৪. নিজের কাছের মানুষ গুলোর সাথে সময় ব্যয় করা
ব্যস্ততার মাঝে একটু সময় হলেই আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুদের সাথে একটু সময় কাটিয়ে ফেলা উচিৎ। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে, কষ্টের কথা আপনজনের কাছে প্রকাশ করলে নিজেকে অনেকটা হালকা লাগে। কাছের মানুষের ভালোবাসা আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস জোগাতে সাহায্য করে। মানুষের সঙ্গে সংযোগ হলে নতুন পথ এবং সম্ভাবনার নতুন আলো খুজে পাওয়া যায়।
৫. স্মৃতিচারণ
শত ব্যস্ততার মাঝে প্রশান্তি আনার জন্য অ্যালবামে রাখা পুরোনো ছবিগুলো নেড়েচেড়ে দেখা একটি চমৎকার কাজ। এটি খুব তাড়াতাড়ি আপনার মন ভালো করে দেবে। পুরোনো ছবির পেছনের গল্প যখন আপনার মনে পড়বে তখন পালিয়ে যেতে পারে সব দুঃখ।
এছাড়াও পছন্দের কোনো ছবি ফেসবুকে পোস্ট অথবা কম্পিউটারের স্ক্রিনসেভারে রাখতে পারেন। এতে মনে নতুন উদ্দীপনা তৈরি হবে। ভালো মন নিয়ে কাজ শুরু করতে পারবেন।
৬. সঠিকভাবে খাদ্য গ্রহণ করুন
অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকলে খাওয়ার প্রতি অনেকেরই অনীহা হতে পারে। মনে রাখবেন, না খেয়ে থাকা চাপকে বা সমস্যাগুলোকে কমিয়ে দেবে না। বরং খাবার আপনার শরীরকে কর্মক্ষম রাখবে এবং চাপ দূর করার পদক্ষেপগুলো নিতে সাহায্য করবে। এ সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন। ক্যাফেইন গ্রহণ কমিয়ে দিন। সকালের নাস্তা ভালোভাবে করুন। দিনে অন্তত ছোটবড় মিলিয়ে ছয় বেলা খাবার খান। ভিটামিন এ এবং ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। পাশাপাশি গ্রিন টি এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের অভ্যাস করুন।
৭. শিথিল থাকতে শিখুন
মানসিক চাপের সময় দেহ ও মনকে শিথিল রাখা জরুরি। মানসিক চাপের কারণ সহজেই চলে যাবে এমনটা নয়। এটা দূর হতে সময় লাগবে। তাই এসময় নিজেকে শান্ত রাখা জরুরি। মনকে শিথিল রাখতে হালকা ধাঁচের গান শুনুন। আর শরীরকে শিথিল রাখতে স্নান করতে পারেন। পার্লারে বা স্যালুনে গিয়ে মানসিক চাপ কমাতে পারে এ রকম ম্যাসেজ করানো যেতে পারে।
৮.গান শুনে / কুরআন তেলাওয়াত শুনে
হঠাৎ কোনো কারণে মন খারাপ হলে গান শুনুন/ তেলাওয়াত শুনুন। এগুলো মানুষের মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। আবার মিউজিকের তালে চাইলে একটু নাচতেও পারেন। পছন্দের কোনো গান শুনলে মুহূর্তেই আপনার মন ভালো হয়ে যেতে পারে। মনে পড়তে পারে সুখের কোনো স্মৃতি। গবেষণায় দেখা গেছে, গান মন ভাল রাখার পাশাপাশি মানসিক ও শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা দূর করে।
৯.ভ্রমণে বের হওয়া
ব্যস্ততার মাঝে সামান্য সময় পেলেই কোথাও ঘুরতে যাওয়া ছোট খাটো ট্যুর দেয়া উচিত। অন্তত ২/৩ ঘন্টার ট্যুর হলেও দেয়া উচিত। এতে করে মন প্রফুল্ল হবে এবং কাজে আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে।
১০. কঠিন কাজটি আগে করি
অনেকেই বলেন, সহজ কাজ দিয়ে দিন শুরু করা উচিত, এটি নিজের প্রতি আস্থা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। সেই সাথে ব্যস্ততার প্রভাবও কমে যায়। কিন্তু আসলে উচিত কঠিন কাজ দিয়েই দিন শুরু করা। কারণ, যখন আপনি কঠিন কাজটি সম্পন্ন করে ফেলবেন, আপনার ওপর থেকে একটা বিশাল মানসিক চাপ নেমে যাবে। এরপর সারা দিন ফুরফুরে মেজাজে কাজ করতে পারবেন আর সঙ্গে মানসিক শান্তি তো আছেই।
১১. মেনে করে নিন অপ্রাপ্তিগুলো
আমাদের সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ হয় না। কিছু অপ্রাপ্তি সবার মধ্যেই থাকে। মানসিক শান্তির জন্য এই অপ্রাপ্তিগুলো মেনে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, অর্থাৎ সন্তুষ্টি। আপনার কাছে যা-ই আছে, তার মাঝে অবশ্যই কিছু ভালো আছে। সেই ভালোকে নিয়ে ভালো থাকাই আপনার ভেতরকার অর্ধেক অশান্তি দূর করে দেবে।
১২.লোকে কী ভাববে তা তাদের ভাবতে দিন
আমাদের মানসিক অশান্তির আরেকটি কারণ মানুষ কী ভাববে, তা ভাবা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মানুষ আদতে আপনাকে নিয়ে কিছুই ভাবেনি কিন্তু আপনি মনে মনে অনেক কিছু ভেবে বসে আছেন। নিজেকে একটি উদ্বেগহীন জীবনের স্বাদ দিতে হলে ‘লোকে কী ভাববে’ এই ভাবনাকেও মাথা থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। এতে করে আমাদের মনের ওপর যে আলাদা চাপ পড়ে, তা দূর হবে এবং নিজের প্রতি নিজের আস্থা বাড়বে।
১৩.এই মুহূর্তের তিনটি ভালো দিক
সব সময় সব দিন ভালো যাবে না—এটাই স্বাভাবিক। অনেক সময় একটার পর একটা দুর্যোগ আসতে পারে আপনার জীবনে। সেই সময়ে মনকে স্থির এবং মনে শান্তি ধরে রাখতে চিন্তা করুন। এই দুর্যোগের মাঝেও আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া অন্তত তিনটা ভালো দিক নিয়ে চিন্তা করুন। এটি হতে পারে সবকিছু সামলে আপনি কাউকে সাহায্য করেছেন, যার বিনিময়ে আপনি কিছু চাননি শুধু একজনের ভালো চেয়েছেন। অনেক কিছুর পরও আপনি আপনার পড়ালেখায় ভালো ফল করতে পেরেছেন, অর্থাৎ নিজের ইতিবাচক দিকগুলোর জন্য সব সময় নিজেকে সাধুবাদ জানান।
১৪. নিজের সাথে কথা বলুন
সর্বোপরি নিজের সাথে কথা বলুন। কোন বিষয়গুলো আপনাকে মানসিক চাপে ফেলছে? কী করলে চাপ কম হতো? বর্তমানে কী অবস্থা? এর পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কী করতে পারনে- এগুলো ভাবুন।
চাপ দূর করতে কী করা প্রয়োজন, এর জন্য একটি তালিকা তৈরি করুন। আপনার চাহিদা অনুসারে তালিকাটি সাজান এবং সেই তালিকা অনুসারে পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। এই পদক্ষেপগুলোর চর্চা মানসিক চাপ দূর করতে সাহায্য করবে।
১৫. টুকটাক ডায়রি লিখুন
আপনি হয়তো কখনোই ডায়রি লেখেননি। তবুও এ সময়টায় নোট প্যাড বা ডায়রিতে কিছু লেখার চেষ্টা করুন। যে বিষয়টি আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে, মানসিক চাপের কারণ হচ্ছে সেটি ডায়রিতে লিখুন। পাশাপাশি আপনি কী চান বা কী করলে আপনার ভালো লাগত সেই বিষয়টিও লিখুন। ডায়রি লেখার এই অভ্যাসটি মানসিক চাপ কমাতে অনেকটা সাহায্য করবে আপনাকে।
১৬.নিজেকে সময় দেয়া
আজকাল ব্যস্ত জীবনে অনেকেই নিজের জন্য সময় বের করতে পারে না। কিন্তু সবারই উচিত ব্যস্ত জীবন থেকে ৫ মিনিট বের করে নিজের কথা ভাবা। কি চাই, কি না চাই, কি করছি, কেন করছি। নিজেকে নিয়ে একটু ভাবা, নিজেকে সময় দেয়া অথবা নিজের জন্য সময় বের করা।
এছাড়াও রয়ছে একটি টেকনিক যার নাম “পমোডোরো কৌশল“।এই পদ্ধতিতে একটি টাইমার ব্যবহার করে যে কোন কাজকে ছোট ছোট সময়ের ভগ্নাংশে ভাগ করে কাজটি সম্পন্ন করা হয়। সাধারনত প্রতি সময়ের ভগ্নাংশের দৈর্ঘ্য ২৫ মিনিট হয় এবং প্রতি ২৫ মিনিট পর পর ছোট বিরতি থাকে। সময়ের এই প্রতি ভগ্নাংশকে পমোডরো বলে যা ইতালীয় এক শব্দ যার অর্থ টমেটো।
এই টেকনিক অনুযায়ী কাজ করলে সেক্ষেত্রেও মাইন্ড অনেক রিফ্রেশ লাগে।
বিখ্যাত একজন লেখক বলেছেন,
“আপনি কে তা পরিবর্তন করতে পারবেন না, তবে আপনার মাথায় যা আছে তা আপনি পরিবর্তন করতে পারেন, আপনি যা ভাবছেন তা রিফ্রেশ করতে পারেন।”