Epilepsy বা মৃগীরোগ
এপিলেপসি (Epilepsy) এক ধরণের স্নায়ুবিক ব্যাধি বা স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতাজনিত রোগ। এটি এমন একটি Chronic Neurological Disease যা মস্তিষ্কে হঠাৎ অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক ক্রিয়াকলাপের(sudden abnormal electrical activity )কারণে ঘটে ও মস্তিষ্কের কোষগুলির মধ্যে মেসেজিং সিস্টেমে একটি অস্থায়ী ব্যাঘাত ঘটায়। সাধারণভাবে একে মৃগী রোগ বলা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে খিচুনি বা কাঁপুনি দিতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এই রোগের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ করেই সাময়িকভাবে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, শরীর কাঁপুনি ও খিচুনি দিতে দিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এই ঘটনা যখন একবার ঘটে তখন তাকে খিঁচুনি (seizure) বলা হয়। আর এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকলে তখন তাকে এপিলেপসি(epilepsy) বলা হয়।
এটি সাধারণত শিশু এবং ৬০ বছর এর উপরে ব্যক্তিদের হয়ে থাকে এবং যেকোনো বয়সের মধ্যেই এই রোগ হতে পারে। সুস্থ–স্বাভাবিক একজন ব্যক্তি যদি হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে কাঁপুনি বা খিঁচুনির শিকার হন, চোখ-মুখ উল্টে ফেলেন কিংবা কোনো শিশুর চোখের পাতা স্থির হয়ে যায়, একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অথবা মানসিকভাবে সুস্থ কোনো ব্যক্তি যদি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন, তবে তাঁকে মৃগীরোগী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বিশ্বে পাঁচ কোটি মানুষের মৃগী রোগ আছে, যার শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই থাকে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশে।
কত ধরনের এপিলেপসি হতে পারে?
৪০টির ও বেশি এপিলেপসির ধরন রয়েছে তবে International League Against Epilepsy এর মতে এপিলেপসি তিন ধরনের হয়ে থাকে-
1.Generalized Epilepsy: এই ধরনের এপিলেপসি পেশেন্ট সাধারণত হঠাৎ করে মাটিতে ফিট হয়ে যান, কাঁপুনি শুরু হয়, মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়, ব্যক্তি অবচেতন অবস্থায় চলে যান।
2.Partial Epilepsy: এই ধরনের এপিলেপসি রোগ ব্রেনের একটি পার্টিকুলার অংশ থেকে শুরু হয় এবং পারিপার্শ্বিক এলাকাগুলো ও সম্পূর্ণ ব্রেনের ছড়িয়ে যেতে পারে। এখানে আবার দুই ধরনের এপিলেপসি রয়েছে। partial epilepsy- যখন ব্যক্তি অজ্ঞান অবস্থায় থাকে না, ব্রেইন কাজ করে এবং অপর একটি হচ্ছে chronic partial epilepsy যখন ব্যক্তির সম্পূর্ণ ব্রেইন এ ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
3. Epilepsy syndrome: এগুলো এমন ধরনের এপিলেপসি সিনড্রোম যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব। এর মধ্যে রয়েছে- infantile spasm, uthahara syndrome, lennox gastaut syndrome
এপিলেপসি বা মৃগী রোগ এর কারণ:
মৃগীরোগ হওয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ নেই এবং শতকরা ৭০ ভাগের ক্ষেত্রে কোনো কারণ বের করা সম্ভব হয়নি। তবে নিম্নোক্ত কারণগুলো থেকে মৃগীরোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে:
- জন্মের আগে বা জন্মের সময় বা পরে মস্তিষ্কে আঘাত।
- আঘাত এবং মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাব।
- সংক্রমণ যা মস্তিষ্কের ক্ষতি করে।
- মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে প্রতিবন্ধকতা (স্ট্রোক বা অন্যান্য সমস্যা)।
- হজমের সমস্যা বা পুষ্টির অভাব।
- মস্তিষ্কের টিউমার।
- দুর্ঘটনার কারণে মস্তিষ্কে আঘাত
৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মৃগীরোগ জেনেটিক প্রবণতা দ্বারা সৃষ্ট। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রথম পর্যায়ের আত্মীয়দের মৃগীরোগের ঝুঁকি দুই থেকে চার গুণ বেড়ে যায়।
এপিলেপসি (epilepsy) বা মৃগী রোগের লক্ষণ সমূহ:
খিঁচুনি বা মৃগী রোগের উপসর্গ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। এটি একজন ব্যক্তির মৃগী রোগের ধরনটির উপরও নির্ভর করে। এর মধ্যে কয়েকটি লক্ষণ নিম্নরূপ-
Simple Partial epilepsy:
- মাথা ঘোরা।
- শরীরে শিহরণ সংবেদন।
- স্বাদ, গন্ধ এবং দৃষ্টিতে পরিবর্তন।
Chronic partial epilepsy:
- রোগীর কোন সাড়া নেই।
- রোগী মহাশূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।
- হাততালি দেওয়া, হাত ঘষা ইত্যাদির মতো পুনরাবৃত্তিমূলক নড়াচড়া করুন।
Generalized epilepsy:
–এটি মস্তিষ্কের সমস্ত অঞ্চলকে জড়িত করে। ছয় ধরনের সাধারণ খিঁচুনি আছে, এবং তাদের সকলেরই বিভিন্ন উপসর্গ রয়েছে।
-টনিক-ক্লোনিক খিঁচুনিতে, শরীরে শক্ততা, মূত্রাশয় নিয়ন্ত্রণ হারানো, কাঁপুনি, জিহ্বা কামড়ানো, চেতনা হ্রাস ইত্যাদি।
-অ্যাটোনিক খিঁচুনিতে, ব্যক্তি তার পেশী নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম এবং পড়ে যায়।
-টনিক খিঁচুনিতে, পেশী শক্ত হয়ে যায়।
-ক্লোনিক খিঁচুনিতে, মুখ, ঘাড় এবং বাহুর পেশীতে বারবার কম্পন হয়।
-মায়োক্লোনিক খিঁচুনিতে, রোগীর হাত ও পায়ে সুড়সুড়ি দেওয়ার লক্ষণ থাকে।
-অনুপস্থিতিতে খিঁচুনি হলে, ব্যক্তি একই কাজ বারবার করতে থাকে, যেমন চোখের পলক ফেলা বা ঠোঁট ফাটানো।-
স্টেটাস এপিলেপটিকাস: পেশীর খিঁচুনি, বিভ্রান্তি, পড়ে যাওয়া, মূত্রাশয় বা অন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ হারানো, দাঁত চেপে যাওয়া, অস্বাভাবিক আচরণ, অনিয়মিত শ্বাস প্রশ্বাস।
এপিলেপসি বা মৃগী রোগের ট্রিগার
-অতিরিক্ত ক্যাফেইন
-অতিরিক্ত অ্যালকোহল
-কিছু ওষুধ
-খাবার এড়িয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত খাওয়া বা অনুপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস
-মানসিক চাপ
-অসুস্থতা যেমন জ্বর ইত্যাদি
-ঘুমের অভাব
-খুব কম রক্তে শর্করা
এই ট্রিগারগুলির যে কোনও একটির কারণে খিঁচুনি ঘটতে পারে বা এই ট্রিগারগুলির সংমিশ্রণের কারণে ঘটতে পারে।
এপিলেপসির চিকিৎসা
এই রোগের তেমন কোন চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা পরিকল্পনা কার্যকরভাবে লক্ষণগুলি পরিচালনা করতে সহায়তা করে। খিঁচুনি আক্রমণ ওষুধ দিয়ে পরিচালনা করা যেতে পারে। ওষুধের প্রতি সাড়া না দেওয়া রোগীদের বিশদ চিকিৎসা ইতিহাস এবং শারীরিক পরীক্ষার পর অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেওয়া হয়।
ওষুধে খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে না এলে অথবা বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে শল্য চিকিৎসা করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। অস্ত্রোপচারের সময় মস্তিষ্কের প্রভাবিত অংশ বাদ দেওয়া হয়। অস্ত্রোপচার তখনই করা হয়, যখন মস্তিষ্কের খুব ছোট এলাকা প্রভাবিত হয় এবং সেই এলাকা শরীরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যেমন: বাক্শক্তি, শ্রবণশক্তি, চলাফেরা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নড়াচড়া ও সমন্বয় ইত্যাদির কোনো ক্ষতি করে না।
এ ছাড়া কিটো-জেনিক ডায়েট, ইপিলেপসি সার্জারি, ভেগাল নার্ভ স্টিমুলেশন (ভিএনএস), রেসপন্সিভ নার্ভ স্টিমুলেশন (আরএনএস) স্টেরিওট্যাকটিক সার্জারি ইত্যাদির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। এসব চিকিৎসা সাধারণত উন্নত বিশ্বে হয়ে থাকে।
মৃগী আক্রান্ত রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা :
– আক্রান্ত রোগীকে মেঝেতে শুইয়ে দিতে হবে এবং গায়ের কাপড় খুলে দিতে হবে।
– আশপাশের ধারালো জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলতে হবে।
– রোগীকে একপাশে করে শোয়াতে হবে যাতে করে লালা বা থুতু মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
– মাথার নিচে নরম কাপড় ভাঁজ করে দিতে হবে।
– রোগীর মুখে কোনো কিছু দেওয়া যাবে না।
– খিঁচুনির পরে রোগীকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম বা ঘুমাতে দিতে হবে।
মৃগীরোগে আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষ সঠিক চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিলে সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন।
এপিলেপসি নিয়ন্ত্রনে সচেতনতা:
– নিয়মিত ওষুধ সেবন করা। ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া ওষুধ বন্ধ কর যাবে না।
– মৃগীরোগ শুরুর কারণ খুঁজে করতে হবে কারণগুলোকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে হবে।যেমন-
- নিয়মিত ওষুধ সেবন করা।
- খাওয়াদাওয়া সময়মতো করা।
- ঘুমানোর জন্য তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার চেষ্টা করা।
- শ্বাসের হালকা ব্যায়াম করা।
- মদ্যপান না করা।
- নেশাজাতীয় ওষুধ সেবন না করা।
- বাড়ির আসবাবপত্রগুলোর কোণ মসৃণ হতে হবে।
- গোসলের সময় গোসলখানার দরজা বন্ধ করা যাবে না।
- সাঁতার কাটার সময় এমন সঙ্গী সঙ্গে রাখুন, যিনি আপনার খিঁচুনি শুরু হলে আপনাকে উদ্ধার করতে পারবেন।
- ঘরের বাইরে কোনো খেলাধুলার সময় মাথায় হেলমেট ব্যবহার করতে হবে।